স্টাফ রিপোর্টার : রাজবাড়ী শহরের সর্বত্রই ব্যাঙের ছাতার মতই গঁজিয়ে উঠছে নাম সর্বস্ব অসংখ্য প্যাথলজি ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। বিশেষ করে রাজবাড়ী সদর হাসপাতাল সড়ক এবং শহরের বড়পুল মোড় থেকে পাবলিক হেলথ পর্যন্ত সড়কের দু’পাশে যেন এসব ডায়াগনস্টিক সেন্টারের হাট বসেছে। তবে নাম সর্বস্ব এসব প্রতিষ্ঠানের নেই তেমন আধুনিক যন্ত্রপাতি ও প্যাথলজিক্যাল সরঞ্জাম। আবার কোন কোনটির স্বাস্থ্য বিভাগের সরকারী অনুমোদন পর্যন্ত নেই। অথচ এসব ভুঁইফোড় ও নাম সর্বস্ব প্যাথলজি ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিকানার সাথে যুক্ত হচ্ছেন রাজবাড়ী সদর হাসপাতালে কর্মরত সরকারী চিকিৎসক।
এমনি একটি প্যাথলজিক্যাল সেন্টারের সন্ধান পাওয়া গেছে রাজবাড়ী শহরের বড়পুল মোড় সজ্জনকান্দা এলাকায়। নুরজাহান ডায়াগনস্টিক সেন্টার নামের এই প্রতিষ্ঠানটির কাগজে কলমে দুই সহোদর আতাউর রহমান মিলন ও সুজনের নাম থাকলেও প্রতিষ্ঠানটির অর্ধেকটার মালিক হচ্ছেন রাজবাড়ী সদর হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার ডাঃ মোঃ ওমর ফারুক পাটোয়ারী। মেডিসিন, গ্যাস্ট্রোলিভার, বাত ব্যাথা, চর্ম, এলার্জি ও শিশু রোগের অভিজ্ঞ চিকিৎসক হিসেবে নিজের নাম জাহির করে বড় বড় সাইনবোর্ডে শিক্ষাগত যোগ্যতা এমবিবিএস ও এফসিপিএস (শেষ পর্ব) উল্লেখে রোগীদের আকৃষ্ট করছেন তিনি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাজবাড়ী সদর হাসপাতালের একজন চিকিৎসক বলেন, এফসিপিএস পাশ করার পূর্বে কোন চিকিৎসক নামের নীচে এফসিপিএস (প্রথম পর্ব/শেষ পর্ব) যাই উল্লেখ করুক না কেন, এটি এক ধরণের প্রতারণা।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, পতিত শেখ হাসিনা সরকারের আমলে করোনাকালীন সময়ে বিশেষ বিবেচনায় সরকারী চিকিৎসক হিসেবে নিয়োগ পান ডা. ওমর ফারুক পাটোয়ারী। রাজবাড়ীতে পোস্টিং পেয়েই নিজের প্রভাব বিস্তারের কৌশল হিসেবে রাজবাড়ী জেলা আওয়ামী লীগের অর্থ সম্পাদক ও সাবেক যুবলীগ নেতা মোস্তাফিজুর রহমান শরীফের আলীশান বাড়ীতে ভাড়া নেন। এখনও সেখানেই তিনি বসবাস করছেন। ওই বাড়ীর নীচতলায় সম্প্রতি একটি বেসরকারী ক্লিনিক ও হাসপাতাল স্থাপন করা হয়েছে। এটির সাথেও তার সম্পৃক্ততার কথা রয়েছে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে।
অভিযোগ রয়েছে, রাজবাড়ী সদর হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের সব ধরণের ক্লিনিক্যাল পরীক্ষার জন্য ডা. ওমর ফারুক পাটোয়ারী তার মালিকানাধীন নুরজাহান ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পাঠান।
অনুসন্ধানে জানা যায়, নুরজাহান ডায়াগনস্টিক সেন্টারের প্যাথলজিক্যাল ল্যাব টেকনোলজিষ্ট হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে রিয়াদ নামে অদক্ষ একজন টেকনিশিয়ানকে। ল্যাব টেকনিশিয়ান হিসেবে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও শিক্ষাগত যোগ্যতা কোনটিই তার নেই। অথচ তিনিই গ্যাস্টোলিভার, মেডিসিন, চর্ম ও এলার্জি সহ বিভিন্ন স্পর্শকাতর রোগীদের রোগ নির্ণয়ে দায়িত্ব পালন করছেন। এর আগেও আরাফাত নামের একজন টেকনিশিয়ানকে দিয়েই কাজ চালানো হত। তবে প্রতিষ্ঠানের মালিক আতাউর রহমান মিলনের প্যাথলিজ টেকনোলজিষ্ট সার্টিফিকেট থাকায় তিনি সকল কাগজপত্রে স্বাক্ষর করে থাকেন। তিনি রাজবাড়ীর বাইরে থাকলে আগেই ল্যাবের প্যাাথলজিক্যাল প্যাডে স্বাক্ষর দিয়ে যান। অনুসন্ধান করলেই প্রমান মিলবে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্যের।
এবিষয়ে প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ডে থাকা ০১৭৪৩-৯২৫১৮১ নং মোবাইল ফোনে বুধবার সন্ধ্যায় কল করলে অপর প্রান্ত থেকে সুজন নামে এক ব্যক্তি পার্টনার পরিচয়ে জানান, এখন ডা. ওমর ফারুক পাটোয়ারী স্যার চেম্বার করছেন। তিনি এই প্রতিষ্ঠানের একজন পার্টনার কিনা জানতে চাইলে সুজন বলেন, তিনি নিয়মিত চেম্বার করেন, তার কোন মালিকানা নেই।
অভিযোগ পাওয়া গেছে, রাজবাড়ীর বিভিন্ন এলাকার পল্লী চিকিৎসকদের মাধ্যমে এই ডায়াগনস্টিক সেন্টারে রোগীর আমদানী করা হয়। এখানে আগত অধিকাংশ রোগীকেই মোটা অংকের টেস্ট ধরিয়ে দেওয়া হয়। এর বড় অংশই পান ডা. ওমর ফারুক পাটোয়ারী। অবশিষ্ট অর্থ ভাগ করা হয় পল্লী চিকিৎসক ও ডায়গনস্টিক সেন্টারের মধ্যে । তবে এখানকার গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট অনেকেরই।
এদিকে নুরজাহান ক্লিনিকের সাথে সংশ্লিষ্ট ডা. ওমর ফারুকের বিষয়ে সম্প্রতি আবু জাফর বিশ^াস নামে এক ব্যক্তি বিভিন্ন দফতরে অভিযোগ করেছেন। ওই অভিযোগের সূত্র ধরে তার কাছে প্রথমে মোবাইল ফোনে এবং পরে হোয়াটসঅ্যাপে ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়ে জানতে চাইলে তিনি হোয়াটসঅ্যাপে অডিও বার্তা দিয়ে রীতিমত মানহানি মামলার হুমকি দেন।
তিনি ওই অডিও বার্তায় পাল্টা অভিযোগ করেন, এবিষয়ে ইতোপূর্বে আরও কয়েকজন সাংবাদিক তাকে রীতিমত বিরক্ত করেছেন এবং তাদেরকে তিনি খুশী করেছেন বলে দাবী করেন।
রাজবাড়ীর স্বনামধন্য চিকিৎসা কেন্দ্র “ডক্টরস কেয়ার” এর সাবেক ল্যাব টেকনোলজিস্ট সোহেল মিয়া বলেন, রাজবাড়ী ডায়াবেটিক হাসপাতাল, রাজবাড়ী ক্লিনিক, মেডিকেল সেন্টার, রাবেয়া স্পেশালাইজড, ডক্টরস কেয়ার, বলাকা সহ প্রতিষ্ঠিত বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান সুনামের সাথেই দক্ষ টেকনোলজিস্ট ও উন্নতমানের রি-এজেন্ট দিয়ে পরীক্ষা-নীরিক্ষা করছেন। বাকী অধিকাংশের অবস্থাই নাজুক। এদের টেকনোলজিষ্ট নেই, টেকনিশিয়ান দিয়েই কাজ করাতে হচ্ছে।
এদিকে রাজবাড়ীতে আশংকাজনকভাবে যত্রতত্র ভুঁইফোড় প্যাথলজি ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার গড়ে ওঠায় সাধারণ মানুষের পাশাপাশি চিকিৎসা সংশ্লিষ্টরাই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তারা এর জন্য রাজবাড়ী স্বাস্থ্য বিভাগের গাফলতি ও উদাসীনতাকে দায়ী করেছেন। সচেতন মহল এবিষয়ে রাজবাড়ী জেলা প্রশাসন ও স্বাস্থ্য বিভাগের যৌথ মোবাইল কোর্ট পরিচালনার মাধ্যমে চিকিৎসা সেবার গুণগত নিশ্চিত করার জোর দাবী জানিয়েছেন।